ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নারীর স্বাধীনতা

নারীর প্রতি বৈষম্য রেখে সোনার বাংলা সম্ভব নয়: রোকেয়া কবীর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯
নারীর প্রতি বৈষম্য রেখে সোনার বাংলা সম্ভব নয়: রোকেয়া কবীর রোকেয়া কবীর: ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: সমাজের অর্ধেক অংশ নারীকে পঙ্গু করে রেখে, নারীর প্রতি বৈষম্য বহাল রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে উঠবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর।

বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি এ মন্তব্য করেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতেই ঢাকার রাজপথে ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠিত নারী ব্রিগেডের মার্চপাস্টের যে ছবি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, সেই মার্চপাস্টের সামনের সারিতে নেতৃত্বে ছিলেন রোকেয়া কবীর।

এছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ছাত্র সংসদে ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই একই সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

নেত্রকোনা জেলার কাটলী গ্রামে ১৯৫১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন রোকেয়া কবীর। ১৩-১৪ বছর বয়স থেকেই তিনি নানা আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। খেলাঘর এবং ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ১৯৬২ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় নেত্রকোনায় শিক্ষা আন্দোলনে অংশ নেন। ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছিলেন সক্রিয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ আয়োজনে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হলে তিনিও সেখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ছাত্রী ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন তিনি।

মার্চপাস্টের কথা জানতে চাইলে রোকেয়া কবির বলেন, নারীদের ডামি রাইফেল নিয়ে মার্চপাস্টের সবার সামনে ছিলাম আমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি শহীদ মিনার, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, কলাবাগান হয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গিয়ে শেষ হয়। মার্চপাস্ট করতে করতে আমরা যখন নগরীর বিভিন্ন সড়ক অতিক্রম করছিলাম তখন সাধারণ মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করছিল। এই মার্চপাস্টের মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আমরা একটা বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। সেটি হলো- আলাপ আলোচলা করে সমস্যার সমাধান হবে না। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন করতে হবে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করলে আমরাও তা প্রতিহত করব এবং আমাদের ছাত্র সমাজ পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। মার্চপাস্টের সামনের সারিতে নেতৃত্বে ছিলেন রোকেয়া কবীর (মাঝখানে)। এই মার্চপাস্টের কারণে ব্যাপক পরিচিত মুখ হয়ে যাওয়ায় রোকেয়া কবীরকে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। এর পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে।

মুক্তিযুদ্ধের কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় মতিয়া চৌধুরী যেখানেই যেতেন, সেখানেই ভিড় লেগে যেত। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়। যেখানেই যাই সকলেই আমাকে চিনে ফেলে, ভিড় লেগে যায়। সেই কারণে আমাকে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। এর পরিবর্তে আমাকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রহ করতাম। তাদেরকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিতাম। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জ্ঞান চক্রবর্তীর সহকারী হিসেবে কাজ করতাম। এছাড়া গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র ট্রেনিং যখন শেষ হত, তখন দেশের অভ্যন্তরে কীভাবে কে কোন পথে ঢুকবে এবং যুদ্ধ করবে সেই ব্যবস্থা আমাকেই করতো হতো।

তিনি আরও বলেন, গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করতে পারা আমার একটা কষ্ট, আর দ্বিতীয় কষ্ট হচ্ছে যখন আমি মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশ ছেড়েছিলাম। তখন শহীদুল্লাহ চৌধুরী (বর্তমানে টিইউসি সভাপতি) আমাকে ভারতে নিয়ে যান। তিনি আমাকে প্রধান সড়ক দিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। রাতের বেলা ধানের ক্ষেতের আল দিয়ে পায়ে হেঁটে আবার কখনো নৌকায় লুকিয়ে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে আমাদের দেশ থেকে অনেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে যায়, আমি দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় সেই অনুভূতি হয়েছিল। আর কখনো ঢাকায় বাবা-মার কাছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রেসকোর্স ময়দান, পল্টন এলাকায় ফিরতে পারব কিনা এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছিল।

আমাদের সামনে ভিয়েতনামের যুদ্ধের উদাহরণ ছিল, যেখানে বছরের-পর-বছর যুদ্ধ হচ্ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কতদিন চলবে তাও আমরা জানতাম না। এই যে দুঃখ, আশঙ্কা এবং হাহাকার, এগুলো খুবই কষ্টের ছিল।

একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার আকাঙ্ক্ষা কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে রোকেয়া কবীর বলেন, আমরা ডিসেম্বর এবং মার্চ মাস এলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে, একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। যে সমাজে নারী-পুরুষে বিভেদ থাকবে না, পাহাড়ি-বাঙালি আদিবাসী এই ধরনের কোনো বৈষম্য করা হবে না। আমাদের সংবিধানেও তাই বলা আছে। দেশে সমাজের অর্ধেক অংশ নারী। নারীর প্রতি বৈষম্য বহাল রেখে সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়। এই বৈষম্য নিরসনে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ মা বোন ধর্ষিত হয়েছে- এ প্রসঙ্গে আপত্তি জানিয়ে তিনি বলেন, বাঙালি মেয়েরা শুধু ধর্ষণের শিকারই হন়নি, সরাসরি তারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। এখনো অনেক মন্ত্রী কথায় কথায় বলেন, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখানে আমার আপত্তি। ইজ্জতের বিনিময় নয়, তারা দৈহিকভাবে আক্রান্ত এবং আহত হয়েছেন। এর জন্য দায়ী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনী।

বর্তমান সময়ে নারীদের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে এবং নারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের সময়ে একজন নারী একা বাসা ভাড়া নিতে পারত না। তবে এখন পারছে। সেই সাথে তারা চাকরি-বাকরি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে এটা একটা অগ্রগতি। তবে সেই সাথে বর্তমান নারীদের মধ্যে রাজনীতি এবং সংস্কৃতি বিমুখতা দেখা যায়। নারীদেরকে রাজনীতি, সংস্কৃতি, অফিস-আদালত সবক্ষেত্রে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। অধিকার কেউ কাউকে এমনি দিয়ে দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয়। কিছু প্রশিক্ষণ দিয়ে দিলেই নারীর ক্ষমতায়ন হয় না। তার চলার পথটাকেও মসৃণ করতে হবে এবং সেই দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সমাজের। নারীসহ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ সবার প্রতি সব বৈষম্যের অবসান হলেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯
আরকেআর/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।